নৈতিকতা MORALITY

নীতিবিদ্যা বা নীতিশাস্ত্র (Ethics) 

নীতিবিদ্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Ethics কথাটি এসেছে গ্রিক Ethica শব্দ থেকে। আবার এ Ethica এসেছে Ethos থেকে, যার অর্থ চরিত্র, রীতিনীতি বা অভ্যাস। নীতিবিদ্যা হচ্ছে মানুষের চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।

নীতিবিজ্ঞানী ম্যাকেঞ্জি বলেন- “নীতিবিদ্যা হলাে আচরণের মঙ্গল বা উচিতের বিজ্ঞান।” মানুষের আচরণ বা ঐচ্ছিক ক্রিয়া (Voluntary action) হচ্ছে নীতিবিদ্যার আলােচ্য বিষয়। নীতিবিদ্যা একটি মানদণ্ড বা আদর্শ কে সামনে রেখে পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে মানুষের আচরণের মূল্যায়ন করে এবং এ আদর্শের সাথে তুলনা করে মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে উচিত বা অনুচিত বলে বিচার করে। যে কাজ আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাকে বলা হয় উচিত, আর যে কাজ আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাকে বলা হয় অনুচিত। জীবনের পরমাদর্শকে লাভ করার জন্য মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করাই নীতিবিদ্যার কাজ। ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক নীতিবিদ্যাকে সবচেয়ে প্রয়ােজনীয় বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরিস্টটলের মতে, নীতির মধ্যেই মানুষ, নীতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ স্বভাব । সুতরাং স্বভাবের এ শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্যই নীতিবিদ্যা পাঠ প্রয়ােজন।নৈতিকতা(Morality) 

নীতিশাস্ত্রের আলােচ্য বিষয় নৈতিকতা। দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সামাজিক কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য মানুষ যে সকল নীতি, আদর্শ এবং সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত অনুশাসন মেনে চলে তার সমষ্টিকে নৈতিকতা বলে। নৈতিক অনুশাসনের প্রভাবে মানুষ আইন মানে, শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করে না এবং রাষ্ট্রের অনুশাসনকে শ্রদ্ধা করে। নাগরিক সচেতনতার মানদণ্ড হলাে নৈতিক অনুশাসন। নেতিকতার ইংরেজি শব্দ Morality; ল্যাটিন শব্দ Moralitas থেকে এটি এসেছে । Moralitas হলো ভালাে আচরণ, চরিত্র প্রভৃতি। কাজেই Morality বা নৈতিকতা হলাে কতিপয় বিধান, যার আলােকে মানুষ তার বিবেকবােধ ও ন্যায়বােধ ধারণ ও প্রয়ােগ করে থাকে।

Dictionary of Social Science গ্রন্থে বলা হয়েছে–”নেতিক অধিকার যা মানুষের নৈতিক অনুভূতির উপর নির্ভরশীল এবং এগুলাে কোনাে বৈধ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সুরক্ষিত নয়।”জোনাথন হেইট বলেন-“ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ- এ তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।”

নীতিবিদ মুর বলেছেন– “শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।”

এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা গ্রন্থে নৈতিকতার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে “নৈতিকতা হলাে দর্শনের এমন একটি শাখা যার মাধ্যমে মানুষ নির্দিষ্ট নৈতিক আচরণ ও কার্যক্রমের সূত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট হয়”

নৈতিক অধিকার বলতে আমরা সে সব অধিকারকে বুঝি যা নৈতিকতা বা ন্যায়বােধ থেকে উদ্ভূত । সমাজের নৈতিকতা বা ন্যায়বােধ থেকে নৈতিক অধিকারের উদ্ভব। যে গুণ মানুষকে অন্যায় হতে বিরত রাখে এবং ন্যায় কাজে নিয়ােজিত করে, তাই নৈতিকতা। যেমন- দরিদ্রের সাহায্য পাবার অধিকার।নৈতিক অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত নয়। এ অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে না। তাই নৈতিকতা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নৈতিকতা সামাজিকভাবে স্বীকৃত গুণ, তবে নৈতিকতা বাধ্যতামূলকভাবে আরােপযােগ্য নয়।

তবে নৈতিক অধিকারের পিছনে সমাজের সমর্থন রয়েছে। কোনাে ব্যক্তি এ অধিকার ভঙ্গ করলে সমাজে তার তীব্র সমালােচনা হতে পারে। সার্থক ও সুন্দর সামাজিক জীবনের জন্য নৈতিক অধিকার অত্যাবশ্যক। নৈতিক অধিকার ব্যক্তি ও সমাজভেদে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। নৈতিক কর্তব্য ব্যক্তি ও সমাজের নীতিবােধের উপর নির্ভরশীল । কোনাে ব্যক্তি নৈতিক কর্তব্য পালন না করলে তাকে সামাজিক ভর্ৎসনা ও সমাজ কর্তৃক নিন্দনীয় হতে হয়। যেমন- বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতাকে প্রতিপালন করা সন্তানের নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু কোনাে সন্তান যদি এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে তবে রাষ্ট্র আইনগত ভাবে তাকে কোন প্রকার শাস্তি দিতে পারে না। কিন্তু সমাজ তাকে ভৎসনা ও নিন্দা করতে পারে । অপরদিকে নাগরিকগণ আইনগত কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকে। আইনগত কর্তব্য ভঙ্গকারীকে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে ।

ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির মনােভাব

ম্যাকিয়াভেলির সমগ্র রাজনৈতিক দর্শন তার সুপ্রসিদ্ধ ও বহুল পঠিত The Prince ও Discourses গ্রন্থদ্বয়ের মধ্যে বিধৃত হয়েছে। উভয় গ্রন্থেই রাষ্ট্র সৃষ্টির ভিত্তি, রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতির কারণ সমূহ বিশদভাবে আলােচিত হয়েছে। উভয় গ্রন্থের আলােচ্য বিষয় মােটামুটিভাবে এক ও অভিন্ন। তবে The Prince গ্রন্থটি রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং Discourses গ্রন্থটি রােমান প্রজাতন্ত্রের সম্প্রসারণ সম্পর্কিত একটি আলােচনা।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্র দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে তার মনােভাব। ম্যাকিয়াভেলি ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথক করেছেন। প্রাচীন যুগে নৈতিকতা এবং মধ্যযুগে ধর্মকে আমরা রাষ্ট্রচিন্তার মূল নিয়ামক হিসেবে দেখতে পাই। যদিও এরিস্টটল নীতিশাস্ত্রকে রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে আলাদা করে দেখছেন তথাপি তাঁর মতে রাষ্ট্র মূলত একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যদিও জন অব প্যারিস, মার্সিলিও অব পাদুয়া প্রমুখ পার্থিপন্থী। চিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রকে গির্জা থেকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করেছেন। তথাপিও তারা ধর্মকে পার্থিব জীবনের পরিমণ্ডল থেকে একেবারে পৃথক করে দেন নাই। বরং ধর্মকে রাষ্ট্রের একটি সহায়ক উপাদান। হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। সুতরাং প্রাচীন বা মধ্য কোনাে যুগেই ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা করা হয়নি। এ দিক নিকোলাে ম্যাকিয়াকে থেকে ম্যাকিয়াভেলিই হচ্ছে প্রথম চিন্তাবিদ যিনি এ দু’টো জিনিসকে। অত্যন্ত নির্মমভাবে রাজনীতি থেকে পৃথক করেছেন এবং তার এই কৃতকর্মের স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ করে তা যে যথার্থ তা প্রমাণ করারও চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্রই হচ্ছে  জীবনের  চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং সেদিক দিয়ে তা অন্য কোনাে উচ্চতর ক্ষমতার অধীন হতে পারে 

না।

Share on